মানুষ ও গণিতের গল্প
শা হী ন আ নো য়া র


গণিত শব্দটির সঙ্গে আমাদের দুঃখ ও ভয়ের স্মৃতি জড়িয়ে আছে; শৈশববেলা থেকেই আমাদের বাবা, মা, শিক সবার কাছ থেকেই গণিত বিষয়ে ভীতি জাগানিয়া সব কথাবার্তা শুনে শুনে আমরা বড় হই; সরল অঙ্কের উত্তর মেলানোর দ্বিধা তো আমাদের সকলের কাছেই কিংবদšতী হয়ে আছে। বলা বাহুল্য, গণিত সম্পর্কে এই ভয় ও বিভ্রাšিত আমাদের প্রজন্ম ধারাবাহিকতায় প্রলম্বিত হয়েছে এবং এই অহেতু গণিত-ভীতি মূলত আমাদের জ্ঞানের প্রতি আগ্রহকেই ধীরে ধীরে ীয়মান করে তুলেছে। কিন্তু বস্তুত গণিত ভয় পাবার মতো জটিল কোন বিষয় নয়; বরং বলা যায়, আমাদের জন্মই হয় গণিতকে সঙ্গে নিয়ে। আমাদের জন্মের ঘটনাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে প্রোটোপ্লাজম, যে নিজেই বৈজ্ঞানিক রহস্যের একটা ভুবন। এখানে বৈজ্ঞানিক তথ্যতে গাণিতিক ভাষায় ব্যবহার করে বলা হচ্ছে, মানুষ মূলত ২১ জোড়া ক্রোমজমের জেনেটিক প্রক্রিয়ার রহস্যময় সৃষ্টি। গণিতের বিষয়-আশয় কিন্তু এখানেই থেমে নেই; যেমন উৎপাদক ক্রোমজম পূর্ণ জীবসত্তায় পরিণত হয় নির্দিষ্ট একটা সময়ে, সংখ্যাবাচক কিছু সপ্তাহের, মাসের বছরের হিসেবে। আবার পূর্ণাঙ্গ জীবের শরীর-অবকাঠামোকে বিশ্লেষণ করতে গেলেও আমাদের অবধারিতভাবে প্রয়োজন গাণিতিক সংখ্যার; আমরা বলি, মানুষের দু‘টো পা, দুটি হাত, দুটো চোখ, একটি নাক, একটি মাথা ইত্যাদি; অর্থাৎ গণিত আমাদের জন্মে ও জীবনে যতই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলুক না কেন আমাদের গণিত-ভীতি দিনে দিনে কেবলই প্রবলতর হচ্ছে। এ লেখাটির একটি প্রাথমিক প্রবণতা হলো, আমাদের অহেতু গণিত-ভীতিকে গণিত-প্রীতিতে রূপাšতর করে প্রকৃত অর্থে জ্ঞানের প্রতি আমাদের আগ্রহকেই বাড়িয়ে তোলা, যাতে করে একদিন আমরা জ্ঞান দিয়েই সবকিছু জয় করতে পারি।

মানুষ, গণিত ও অন্যান্য

মানুষজন্ম লাভ করেই আমরা দেখি, প্রভাতে সূর্য উঠছে, আবার ১২ ঘণ্টা পর ডুবে যাচ্ছে; সূর্যকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্য চাঁদও নাকি একা একা সারারাত ১২ ঘণ্টা জেগে থাকেন আকাশে। ফলে আমাদের পৃথিবী নামের এই গ্রহটিতে তৈরি হয় ঐন্দ্রজালিক ২৪ ঘণ্টার রাত ও দিন। আর এভাবে ক্রমে আমাদের কোলে নিয়ে জননী বসুন্ধরা ৩৬৫ দিন ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে একবার পরিভ্রমণ করে আসে তাপ-প্রদায়ক নত্র সূর্যকে। তবু এই ধুলোমলিন পৃথিবীতে মানুষ এবং শুধু মানুষই হয়ে ওঠে যাবতীয় গবেষণার উৎসভূমি; মানুষের এই অবিসংবাদিত হয়ে উঠার কারণ হয়তো সে সৃষ্টির সেরা জীব বা সে নিজেকে তার বুদ্ধিবৃত্তির কারণে সেরা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে বলে সবকিছু ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রিত হয়। তো সেরা সৃষ্টি মানুষের দুই হাতের দশটি আঙুলের কলাকৌশলের মধ্যেই তার শ্রেষ্ঠত্ব লুপ্ত হয়ে থাকে। দশটি আঙুলের ৪০টি কড়ের মাধ্যমে তৈরি হয় কুড়ির হিসেব; এমনকি হাজারেরও উপর সংখ্যা গণনার যন্ত্র হিসেবে আমরা কড়ের ব্যবহার করতে পারি। এমন গণনা-যন্ত্র কী অন্য জীবের আছে! গবেষণায় অবশ্য দেখা গেছে প্রতিটি জীবই কিছু গণনা কৌশল জানে যা ৪- এ গিয়েই থেমে যায়। এই পরীাটি আপনি আপনার বাড়িতে করতে পারবেন; আপনি ৪টির বেশি বাচ্চা আছে এমন একটা মুরগিকে বেছে নিন। এবার মা মুরগির অজাšেত একটা একটা করে বাচ্চা সরিয়ে নিন, দেখবেন ৪টির কম বাচ্চা হলে মা মুরগিটির মাতৃত্ববোধ জাগ্রত হবে, তার আবেগজনিত আচরণের কিছুটা আপনিও টের পাবেন। বস্তুত একসময় আদিম মানুষেরা তাদের অ¯িতত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য গণনা পদ্ধতির ব্যবহার শুরু করেছিল। আদিম মানুষের খাবার ছিল প্রধান সমস্যা; এজন্য প্রতিদিন তাদের শিকারের সন্ধানে ছুটতে হতো। হয়তো একদিন তারা ৫টি ছাগল শিকার করতে পারলো, পরের দিন আর কয়টা শিকার পেলে আর লাগবে না, এই হিসেব তাদের করতেই হতো। ফলে সভ্যতার শুরুতেই গণনা অর্থাৎ গণিত একটা প্রভাবদায়ী ভূমিকা রাখতে পেরেছিল। মানুষের প্রয়োজনের সীমানা যখন কুড়িকে ছাপিয়ে গেল তখন গ্রিক ও সিন্ধু সভ্যতায় জন্ম হলো গণিতজ্ঞের। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল গণিতেরই বিভিন্ন শাখার বিকাশের মাধ্যমে। মূলত ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের উত্তর পশ্চিম ভারত আক্রমণের মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে গ্রিসের একটা সম্পর্কের সূচনা হয়; এই সম্পর্কের আদান-প্রদানের সঙ্গে জড়িয়ে যায় গণিত; যদিও খ্রিস্টিয় চতুর্থ বা পঞ্চম শতাব্দীর আগে পর্যšত ভারতীয় গণিতের তেমন নিদর্শন পাওয়া যায় না, শুধু মৌর্য সম্রাট অশোকের সময়ে ভারতের বিভিন্ন শহরে নির্মিত প্র¯তর ফলকে ভারতীয় সংখ্যা প্রতীকের ব্যবহার দেখা যায়। সম্রাট অশোকের পাঁচ শতাব্দীকাল পরে গুপ্ত আমলে শিা ও সংস্কৃতিতে ভারতে রেনেসাঁ শুরু হয়, বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেখানে পণ্ডিতেরা বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, জ্যোতির্বিদ্যা আলোচনা শুরু করেন।

শূন্যে অসীমের ধারণা

শূন্য সম্ভবত গণিতের সবচেয়ে রহস্যময় সংখ্যা। প্রাচীন গ্রিস, মিশর, ও ব্যবলীনীয় সভ্যতা মানুষকে নিয়ে গিয়েছিল অনেক দূর পর্যšত। কিন্তু তারা শূন্য ব্যাপারটি অনুধাবন করতে পারেন নি। ভারতীয় পণ্ডিতেরাই প্রথম সংখ্যা-লিখনের ভিত্তি হিসেবে ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ এর পরে শূন্য ধারণার অবতারণা করেন। বিষয়টি কিভাবে ভারতীয় গণিতজ্ঞগণের ধারণায় এসেছে তা এখনও গবেষণার ব্যাপার। তবে মনে করা হয় জ্যোতির্বিদগণের ধারণা এই মহাবিশ্ব একটি সুতার ন্যায় শূন্য বস্তু থেকে জন্ম আবার একদিন সমস্ত মহাবিশ্ব ধ্বংস হবে বা শূন্য হয়ে যাবে। যাকে বিগব্যাঙ্গ বলা হয়ে থাকে। এটিই একমাত্র সংজ্ঞা নয়। আরও অনেকভাবে শূন্য জন্মের রহস্য উদঘাটনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করছেন পৃথিবীর গণিতজ্ঞগণ। সে যাই হোক ফিরে আসি শূন্যের ব্যবহারের দিকে। শূন্যের জন্য প্রথম প্রথম কোন চিহ্নই ছিল না। একটি শূন্য জায়গা বা ফাঁকা চিহ্ন দিয়ে শূন্যের অবস্থান বোঝানো হতো। পরে একটি খুব ছোট বিন্দু দিয়ে শূন্যের অবস্থান নির্দেশ করা হতো। কালক্রমে আরবদের মাধ্যমে যখন এ সংখ্যা-লিখন পদ্ধতি ইউরোপে প্রচারিত হলো, তখনই শূন্যের কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানের ছোট গোল বলের আকৃতি গ্রহণ করল। আজ পর্যন্ত এ মতের প্রধান সমর্থন আসছে খলিফা আল-মামুনের গ্রন্থাগারের অধ্য সুবিখ্যত গণিতবিদ আল খারিজমের ৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে লিখিত একটি গণিত পুস্তক থেকে। এই গ্রন্থে শূন্যের ব্যবহার উল্লেখ করে একে ভারতীয় উদ্ভাবন বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আবার ৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে খোদিত কয়েকটি ভারতীয় শিলালিপি পাওয়া গেছে, যাতে শূন্যের ব্যবহার করা হয়েছে। আরব গণিতবিদেরা ভারতীয় সংখ্যাতত্তে¡র সুদূরপ্রসারী প্রভাব বুঝতে পেরে এক পুরোপুরি আত্মস্থ করেন। বর্তমান ইংরেজিতে ব্যবহৃত ‘তবৎড়’ শব্দটি সংস্কৃত ‘শূন্য’ শব্দেরই চূড়ান্ত রূপ। ‘শূন্য’ বা ‘ফাঁক’- এর আরবি ‘সিফর’ থেকে ইংরেজি শব্দ ‘সাইফার’ (ঈরঢ়যবৎ) [শূন্য কিন্তু ‘০’ নয়] এসেছে। আরবি সিফর শব্দ ইতিলীয় ভাষায় হয়েছে। তবাবৎড় (জেভেরো), এর থেকে এসেছে ইংরেজি শব্দ ‘জিরো’। গণিতের জগতে শূন্যের ব্যবহার ছিল ভারতীয়দের এক অভাবনীয় সাফল্য।
= ৩. ১৪১৫৯ ২৬৫৩৫ ৮৯৭৯৩২৩৮৪৬ ২৬৪৩৩ ৮৩২৭৯ ৫০২৮৮ ৪১৯৭১ ...
হচ্ছে সংখ্যাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। এটি একটি বৃত্তের পরিধি এবং এর ব্যাসের অনুপাত। অতি প্রাচীনকাল থেকেই জানা ছিল বৃত্তের পরিধির সঙ্গে ব্যাসের কোনো নির্দিষ্ট অনুপাত বা সম্পর্ক আছে। কিন্তু সে অনুপাতই যে কত, তা সম্পর্কে ধারণা ছিল খুব অস্পষ্ট। ব্যাবিলনীয় ও হিব্র“দের ধারণা ছিল এই অনুপাত ৩ : ১। মিসরীয়রা সত্যের আরও একটু কাছাকাছি গিয়েছিলেন। তাঁরা -এর পরিমাণ নির্ণয় করেছিলেন ৩.১৬০৫। আর্কিমিডিস নির্ণয় করেছিলেন এর পরিমাণ ৩.১৪০ থেকে ৩.১৪২ -এর মধ্যে। আর তৎকালীন পাটলিপুত্র পাটনা নগরের বিখ্যাত গণিতবিদ আর্যভট্টের (৪৭৫-৫৫০) হিসাব ছিল আরও নির্ভুল। তাঁর হিসাব অনুসারে এর মান দাঁড়ায় ৬২৮৩.২  ২০০০ = ৩.১৪১৬। বর্তমান স্বীকৃত মানের সমান। বলে রাখা ভালো, তখনো সংকেতটি প্রবর্তিত হয়নি। এর ব্যবহার শুরু হয় মাত্র অষ্টাদশ শতাব্দীতে।

জোতির্বিদ্যা

ভারতীয় গণিতবিদেরা প্রাথমিকভাবে নিজেদের জ্যোতির্বিদ্যা আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। বীজগণিত ও ত্রিকোণমিতি প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচিত হয়। প্রথম যুগের একটি বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ্যার বই হচ্ছে সূর্য সিদ্ধান্ত। এটি খুব সম্ভবত চতুর্থ শতাব্দীতে ‘লতা’ নামের একজন গণিতবিদের দ্বারা রচিত হয়। এই পুস্তকে তৎকালীন ত্রিকোণমিতিক ও জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান সংগ্রহ করে রাখা হয়। গণিতবিদ আর্যভট্টও জ্যোতির্বিদ্যা ও ত্রিকোণমিতির ওপর কাজ করেন। এর পরের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ছিলেন বরাহমিহির (৫০৫-৫৮৭), যিনি পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তগুলো সংগ্রহ করে পঞ্চ সিদ্ধান্ত বলে বিখ্যাত পুস্তক রচনা করেন। এটি খুব সম্ভবত গ্রিক জ্যোতির্বিদ টলেমির কাজ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এর পরে এবং সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ ভারতীয় গণিতবিদ ছিলেন ব্রহ্মগুপ্ত (৫৯৮-৬৬৫) খ্রি.)। তিনি তৎকালীন ভারতের জ্যোতির্বিদ্যার কেন্দ্রস্থ উজ্জয়িনীতে বাস করতেন এবং সেখানেই গণিত ও বিজ্ঞানচর্চা করেন। তিনি বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ্যার বই ব্রহ্মসফুট সিদ্ধান্ত বা সংেেপ সিদ্ধান্ত রচনা করেন। এ বইটিই আরবিতে সিন্দ হিন্দু নামে অনূদিত হয়। এটি আরবদের জ্যোতির্বিদ্যা আলোচনায় প্রভূত প্রভাব বিস্তার করে। এরপর দণি ভারতের বিখ্যাত গণিতবিদ মহাবীর (আ. ৮৫০ খ্রি.) এবং সমসাময়িক কালের বাচষ্পতি (আ. ৮৫০ খ্রি.)। ব্রহ্মগুপ্তের কাজের ওপর আরও উন্নতি সাধন করেন। প্রাচীন ভারতের সর্বশেষ বিখ্যাত গণিতবিদ ছিলেন ভাস্করাচার্য্য, যিনি আনুমানিক ১১১৪-১১৮৫ অব্দে জীবিত ছিলেন। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ্যার বই হচ্ছে সিদ্ধান্ত শিরোমণি। অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত এ বইটি প্রাচীন ভারতের জ্যোতির্বিদ্যার ওপর সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ।

জ্যামিতি বা ত্রিকোণমিতি

ভারতীয়রা টলেমির সিন্ট্যাক্সিস রচনার পর তিন-চার শতাব্দীর মধ্যে জ্যা-সম্বন্ধীয় তথ্যাদি আয়ত্ত করে ফেলেন। আর্যভট্ট অনেক জটিল হিসাব করেছিলেন, যার ধরনকে জ্যামিতিক না বলে বরং গাণিতিক বা বীজগাণিতিক বলা যেতে পারে। আর্যভট্ট দুটো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করেন।
প্রথমত, তিনি ‘জ্যা’ -এর পরিবর্তে অর্ধ জ্যা ব্যবহার করেন; দ্বিতীয়ত, চাপ (বা কেন্দ্রস্থ কোণ); ব্যাসার্ধ, অর্ধ জ্যা সর্বেেত্র একই একক। কৌণিক মিনিটের ব্যবহার প্রবর্তন করেন; আসলে রেডিয়ান একক প্রবর্তনের সম্মান আর্যভট্টেরই প্রাপ্য।

বীজগণিত

আর্যভট্ট বীজগণিতের ওপরও মূল্যবান অবদান রাখেন। তিনি অনিশ্চিত সমীকরণ সম্পর্কে আলোচনা করেন। ব্রহ্মগুপ্তও অনিশ্চিত সমীকরণের বি¯ৃ—ত আলোচনা করেন এবং এর সাধারণ সমাধান প্রদান করেন। তিনি সর্বপ্রথম ী২-১০ী = -৯ এই দ্বিঘাত সমীকরণের একটি ধনাত্মক মূূল নির্ণয়ের পদ্বতি আলোচনা করেন, যা আজকের অতি পরিচিত ‘ঈড়সঢ়ষবঃরহম ঃযব ঝয়ঁধৎব’ বা বর্গীকরণ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিকে আজও অনেকে হিন্দু পদ্ধতি নামে ঊল্লেখ করেন। ব্রহ্মগুপ্তের গণিতের কাজ ‘কনক’ নামে এক ভারতীয় গণিতবিদ কর্র্তৃক বাগদাদের খলিফার দরবারে হাজির করা হয় এবং এখান থেকেই আরবরা ভারতীয় সংখ্যা লিখন পদ্ধতি [যেখানে প্রথম শূন্যের ব্যবহার ঊল্লেখ করা হয়] সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করেন।
ভাস্করাচার্যের সিদ্ধান্ত শিরোমণি বইয়ের একটি অংশ ছিল বীজগণিত। তিনিই প্রথম বলেন, একটি দ্বিঘাত সমীকরণ, যার বাস্তব সমাধান আছে তার দুটি মূল থাকবে। গ্রিক গণিত যেমন জ্যামিতিপ্রধান ছিল, ভারতীয় গণিত ছিল তেমনি পাটিগণিত এবং বীজগণিতকেন্দ্রিক। প্রথম দিকে ভারতীয় বীজগণিত ছিল ‘বাক্যসর্বস্ব’ (জযবঃড়ৎরপধষ)। কিন্তু পরবর্তীকালে একটি সংিেপত শব্দ প্রতীকসংবলিত (ঝুহপড়ঢ়ধঃবৎ) রূপ ধারণ করে। তাঁরা ধনাত্মক সংখ্যার অস্তিত্ব স্বীকার করেন এবং দ্বারা –ধ নির্দেশ করতেন।
ভারতীয়দের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল অনিশ্চিত সমীকরণের সাধারণ সমীকরণ নির্ণয় পদ্ধতি। তাঁরা ধী+নু = প এই ধরনের সমীকরণের পূর্ণ সংখ্যা সমাধান বের করেছিলেন ‘সিঁড়ি ভাঙা ভগ্নাংশ’ (ঈড়হঃরহঁবফ ভৎধপঃরড়হ) পদ্ধতি অবলম্বনে, যা আজও প্রচলিত। এ পদ্ধতি গ্রিক গণিতবিদ ডায়োফান্টাসের পদ্ধতির চেয়ে উন্নততর ছিল।
ভারতীয়রা সমান্তর শ্রেণী, গুণোত্তর শ্রেণী। সমাবেশ এবং কোনো কোনো উচ্চঘাতের সমীকরণ ও সমাধানের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।
এতো গেল ভারতীয় গণিতবিদদের গণিতে অবদানের সংপ্তি সাতকাহন গীত শুনলাম। আজ গণিতের এত ব্যাপক প্রসার প্রচার যে আমাদের ভারত গণিতবিদদের সেই আবিষ্কারকে মাথায় নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশ তাদের আলোকিত যাত্রার পথ আবিষ্কার করার নেশায় মত্ত।
বিজ্ঞান সভ্যতার সূচনা লগ্নে চাকা আবিস্কার ছিল গাণিতিক সমস্যার সমাধান করার লইে। যখন একজন মানুষ ১ কি.মি. রাস্তা পায়ে হেঁটে ২০ মিনিটে অতিক্রম করতেন তখন ২৮/২৯ ইঞ্চি ব্যাস বিশিষ্ট একটি চাকার সাহায্যে মাত্র ৫/৬ মিনিটের মাধ্যমে অতিক্রম করার কৌশল তৈরী করেন। এভাবে গণিতের মাধ্যমেই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সূচনা হল।


এবং কম্পিউটার...

প্রাচীন চৈনিক গণিতজ্ঞবিদগণ গণনাকে দ্রুততার সহিত করার জন্য আবিস্কার করেন এ্যাবাকাস নামক যন্ত্র। এরপর আরও জটিল গণনার জন্য নেপোরিয়ার তার হাড় দিয়ে তৈরী করা যন্ত্র আবিষ্কার করেন। যদিও যন্ত্রটি বহুল ব্যবহৃত হয় নাই। এরপর ব্লেইজ প্যাসকেল বাবার আদমশুমারীর কাজটি সহজে করার জন্য ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করেন। তারপরও যখন আরও জটিল গণিত সমস্যা সমাধান করার প্রয়োজন হলো যা পূর্বের কোন যন্ত্র দ্বারা সমাধান করা যায় না, তখন ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক চালর্স ব্যাবেজ তৈরী করলেন ডিফারেন্স ইঞ্জিন। যা আজকের আধুনিক কম্পিউটার নামের আদিরূপ।
কম্পিউটারের কর্মসাধন নিয়ে যে গবেষণা চলছে তা হচ্ছে সময়কে কত ুদ্রতম করা যাবে, কত দ্রুত কম্পিউটারে কোন সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে এবং সেটা দ্বারা কত প্রকার কর্ম সাধন করা যাবে। পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় পুরে বিশাল পৃথিবীকে নিজের করে পাওয়া যাবে তারই প্রচেষ্টা। বিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণায়- জীবের ুদ্রতম থেকে ুদ্রতম আবিষ্কার করার প্রচেষ্টা। আবার বৃহত্তম থেকে বৃহত্তম করার প্রচেষ্টা ইত্যাদি। মনোবিজ্ঞানীগণ মনে করেন, আমাদের মস্তিষ্কের গাণিতিক যুক্তি অংশের ল কোটি নিউরন এমনভাবে কাজ করতে সম যা পরিমাপ করা অসম্ভব। এটাকে আমরা বিশলতার উপমা দিয়ে বলতে পারি। যা অনির্দিষ্টভাবে চলতে থাকে। এ যেন বিশালতারই উপমা।

সংখ্যার বৈচিত্র্য

দৈনন্দিন জীবনে আমরা সাধারণত শতক কিংবা হাজার, ব্যবসায়িতক কাজে লাখ বিংবা মিলিয়ন অথবা কোটি কিংবা মিলিয়ন অথবা কোটি কিংবা বিলিয়ন পর্যন্ত ব্যবহার করি। যেকোন ধরনের বিল পরিশোধ করতে দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করতে কিংবা চেক বুক ব্যালান্স করতে আমরা এ পর্যন্ত সংখ্যাগুরোই ব্যবহার করি। সংবাদপত্রে কিংবা বিভিন্ন দেশের সরকার বাজেট ঘোষণা কিংবা বিভিন্ন চুক্তিতে আরও কিছু বিশালতর সংখ্যা ব্যবহৃত হয়। বৃহত্তর সংখ্যাগুলো সাধারণভাবে বিজ্ঞানীরাই ব্যবহার করেন। এখানে এরকম একটি তালিকা দেওয়া হেলো। এক ট্রিলিয়নের পরবর্তী সংখ্যার ব্যবহার সাধারণ মানুষের কাছে অপরিচিত। যেমন:
১০২ ১০০ শতক
১০৩ ১,০০০ হাজার
১০৬ ১,০০০,০০০ মিলিয়ন
১০৯ ১,০০০,০০০,০০০ বিলিয়ন
১০১২ ১,০০০,০০০,০০০,০০০ ট্রিলিয়ন
১০১৫ কোয়াড্রিলিয়ন
১০১৮ কুইন্টিলিয়ন
১০২১ সেক্রটিলিয়ন
১০২৪ সেপটিলিযন
১০২৭ অকটিলিয়ন
১০৩০ নোনিলিয়ন
১০৩৩ ডেক্রিলিয়ন
১০৩৬ আনডেসিলিয়ন
১০৩৯ ডিওডেসিলিয়ন
১০৪২ ট্রেডেসিলিয়ন
১০৪৫ কোয়টার ডেসিলিয়ন
১০৪৮ কুইনডেসিলিয়ন
১০৫১ সেক্রডেসিলিয়ন
১০৫৪ সেপডেসিলিয়ন
১০৫৭ অক্টোডেসিলিয়ন
১০৬০ নোবেমডেসিলিয়ন
১০৬৩ ভিজিনটিলিয়ন
এখানে কিছু সংখ্যার নাম আশ্চর্যজনক এবং এগুলোর ব্যবহারেও প্রশ্ন দেখা দেয়। কারণ, আমরা টিলিয়ন পরবর্তী সংখ্যাগুলো ব্যবহার করি না বললেই চলে। তবুও গণিতবিদেরা বৃহত্তর সংখ্যার সন্ধানে ব্যস্ত ছিলেন এবং বিভিন্ন নামকরণ করেন। উদাহরণ হিসেবে দেওয়া যায়, ১০১০০ (১-এর পরে ১০০টি শূন্য) সংখ্যাটির নাম দেওয়া হয়েছে গুগল (মড়ড়মষব) । সংখ্যাটি লিখলে হয়:
১০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০
বৃহৎ সংখ্যাই বটে! কিন্তু এই গুগল বৃহত্তম সংখ্যা নয়। কেননা আমাদের ১০মড়ড়মষব, যাকে বলা হয় গুগলপ্লেক্স। ধারণা করা হয় এ সংখ্যাটি লিখতে ৩০০ পৃষ্ঠার একটি খাতা দরকার, যেখানে আট ল ডিজিট থাকবে।
যখন বিশ্ব এই বিশালতার মধ্যে অবগাহন করছে। আর সৃষ্টিতেই যেখানে সৃষ্টিকর্তা গণিতে বেঁধে দিয়েছেন। সেখানে গণিতকে কেন এত ভয়? মনোবিজ্ঞানীগণ মনে করেন, আমাদের মস্তিষ্কের গাণিতিক যুক্তি অংশের ১,০০,০০০ (একল) ভাগের ৬০ ভাগ যদি কাজে লাগাতে সম হই তবে ৫০টি সুপার কম্পিউটারের সমান কাজ করতে সম হব।

অতঃপর কাকস্য পরিবেদনা

আমরা বাস করছি এমন এক সময়ে যখন বিজ্ঞান ছাড়া কিছুই ভাবা যায় না; আমরা এক পা হাঁটি, খাই, কথা বলি সব বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে। পৃথিবী কত এগিয়ে যাচ্ছে, আর আমরা ক্রমে পিছিয়ে যাচ্ছি। এই পেছোনোর কারণ যে বিজ্ঞান শিার প্রতি আমাদের অনীহা, একথা বলতে কোন দ্বিধা নেই। আমাদের দেশের মানুষ মস্তিষ্কের একল ভাগের ১ ভাগ কাজে লাগাতে সম কি না? তাতেই আমার সন্দেহ। আমরা যদি গণিত চর্চা করতে সম হই তবেই আমরা বিজ্ঞান চর্চায় সফল হব। কারণ গণিতই বিজ্ঞানের জনক। যখন আমরা ইতিহাস, ধর্ম, যুক্তিবিদ্যা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে উচ্চ শিা গ্রহণ করছি বা বিমূর্ত শিায় ব্যস্ত ঠিক একই সময়ে উন্নত রাষ্ট্রগুলি বিজ্ঞান চর্চায় লিপ্ত। আর তাইতো তারা উন্নত আর আমরা অনুন্নত। আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিার্থীরা মানবিক, ব্যাবসায় বাণিজ্য বিষয়ে পড়াশুনা করতে আগ্রহী। তার কারণ তারা গণিত ভাল বুঝতে পারে না। আর বুঝবেই বা কেমন করে? তাদের গণিতের মূল ভিত্তিই অনুপস্থিত। তারা গণিতকে অঙ্ক বলে। অঙ্ক কী? তা তাদের জানা নেই। সংখ্যা কী তাদের শেখানো হয় না। মুল গাণিতিক বিষয়গুলি শিার্থীদের শেখানো হয় না। সুতরাং তার ফলাফল ‘মোটের উপর গণিতে শূন্য’। আমাদের শিকগণকে গণিত বিষয়ের শিখন-শিণ প্রক্রিয়ার ভুল-ত্র“টিগুলিকে চিহ্নিত করতে হবে। সেই ভুলত্র“টির সংশোধন কিভাবে করা যায় তার যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে। গণিতকে কাঠখোট্টাভাবে না উপস্থাপন না করে সহজ, সরল, রসাত্মকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। গণিত আমাদের নিত্য জীবনেরই অংশ। জীবনকে বিশ্লেষণ করলেই গণিতের বাস্তব সমস্যা বের হবে এবং বাস্তবতার আলোকেই সমাধান করতে হবে। বাস্তব উপকরণের মাধ্যমে গণিত শিখন-শিণ পদ্ধতির প্রয়োগ করার চেষ্টা করতে হবে। গণিতের বিভিন্ন মজার মজার গল্প আছে সেগুলিকে শিার্থীদের শোনাতে হবে। গণিতে মজার মজার ধাঁধার মাধ্যমে শিার্থীদের মাথাখাটানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিক নিজের কৌশল ও দতা দ্বারা অনেকভাবেই গণিতকে সকলের বোধগম্য করতে সম হবেন। বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানাগার তৈরী করা। বিজ্ঞানের জন্য সরকার কর্তৃক প্রাপ্ত ল্যাবরোটরীর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা। শুধু তার ইচ্ছা ও একটু চেষ্টার প্রয়োজন। তবেই আমাদের দেশে শিার্থীদের বিজ্ঞান চর্চায় উদ্বুদ্ধ করা ও দেশে বিজ্ঞানের জয় যাত্রা সম্ভব হবে। বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে গণিতের বিভিন্ন প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেটা হতে পারে অন্তঃস্কুল, আন্তঃস্কুল, উপজেলা, আন্তঃজেলা, বিভাগীয় পর্যায় ইত্যাদি। বিজ্ঞান মেলা প্রদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সমাজের জ্ঞানী ব্যক্তিদের এই সকল ব্যবস্থা গ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের শিল্পপতিদের উচিত শিল্পের উন্নয়নের জন্য আমাদের সন্তানদেরকে উৎসাহিত করা, তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে কিভাবে উন্নত করা যায় তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। গণিত অলিম্পিয়ার্ড-এর মত গণিত উৎসবে সকল বিদ্যালয়ের সকল শিার্থীদের অংশ গ্রহণ করানোর যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো ব্যস্ত কন্ঠশিল্পি তৈরীতে। কারণ দর্শক পাওয়া যায়। তারাতো ব্যবসায় ব্যস্ত। কিন্তু মিডিয়াগুলো যদি গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ক অনুষ্ঠানকে জনগণের মধ্যে বেশি বেশি প্রচার করতে তবে কিন্তু বিজ্ঞান চর্চা আরও চেষ্টা চলত। এই েেত্র সরকারের ভূমিকা সর্বোচ্চ। সরকার যদি বিজ্ঞান ও গণিতবিদগণের আবিষ্কারকে যথাযথ মর্যাদাদান ও পুরস্কারের ব্যবস্থা নিতেন। মাঠ পর্যায় থেকে মনিটরিং টিমের মাধ্যমে বিদ্যালয় থেকে ুদে গণিতবিদদের বেছে নিতে পারে এবং এই সব গণিতবিদদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করে তবে আমাদের দেশও গণিত ও বিজ্ঞানে বিশ্বদরবারে উন্নত রাষ্ট্র হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।

0 comments:

Post a Comment